ভারতবর্ষ একসময় ছিল খেলাধুলার প্রাণবন্ত দেশ। গলির ক্রিকেট, স্কুলের ফুটবল, মল্লখেলা কিংবা কাবাডি—সব মিলিয়ে শিশু ও কিশোরদের জীবনে মাঠ ছিল এক অপরিহার্য অংশ।
কিন্তু আজকের দৃশ্যপট ভিন্ন। স্মার্টফোন, ভিডিও গেম ও অনলাইন বিনোদনের দ্রুত বিস্তারে মাঠ ফাঁকা হচ্ছে, পর্দা ভরছে। এর প্রভাব শুধু বিনোদনের পরিবর্তনেই সীমিত নয়; স্বাস্থ্য, মানসিক বিকাশ, সামাজিক দক্ষতা এবং জাতীয় ক্রীড়াক্ষেত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। তথ্য যা বলছে সাম্প্রতিক India Report Card 2022 on Physical Activity জানাচ্ছে, মাত্র প্রায় ৩০-৩৫% ভারতীয় শিশু ও কিশোর প্রতিদিন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রস্তাবিত ৬০ মিনিট মাঝারি থেকে তীব্র শারীরিক কার্যকলাপে অংশ নেয়। শহুরে এলাকায় এই হার আরও কম। বেঙ্গালুরুতে শিশুদের গড় শারীরিক কার্যকলাপ প্রতিদিন প্রায় ৪৯ মিনিট, আর চেন্নাইয়ে নেমে গেছে মাত্র ২৬ মিনিটে। অন্যদিকে ১০–১৯ বছর বয়সী কিশোরদের মধ্যে স্ক্রিনটাইম প্রতিদিন গড়ে ৩.৮ ঘণ্টা। এসব সংখ্যা আমাদের ভবিষ্যতের একটি ভয়াবহ চিত্র আঁকছে।
যার ফলে বাড়ছে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি শারীরিক কার্যকলাপের অভাব ভারতের জন্য নতুন নয়। ইতিমধ্যেই দেশের তরুণ সমাজে স্থূলতা, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। চেন্নাই ও পুনের কলেজপড়ুয়াদের মধ্যে ১৩–১৯ শতাংশ স্থূলতার শিকার। ডাক্তাররা সতর্ক করেছেন, বাইরে খেলাধুলার অভাব ও দীর্ঘ সময় বসে থাকার কারণে শিশুদের হাড় দুর্বল হচ্ছে, ভিটামিন–ডি ঘাটতি বাড়ছে। দীর্ঘমেয়াদে এটি জাতির স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর মারাত্মক চাপ তৈরি করবে। মাঠের খেলায় শেখা যায় দলবদ্ধতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, নেতৃত্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বীকে সম্মান করা। এগুলো ছাড়া সুস্থ সামাজিক বিকাশ সম্ভব নয়। কিন্তু আজকের শিশু যখন বেশিরভাগ সময় ভার্চুয়াল জগতে ব্যয় করে, তখন তার বাস্তব যোগাযোগ ও সামাজিক দক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফল হতে পারে একাকীত্ব, বিষণ্নতা এবং আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি।
যে কারনে ভারতবর্ষ ক্রিকেট, হকি বা অ্যাথলেটিক্সে আন্তর্জাতিক সাফল্যের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু মাঠেই যদি নতুন প্রজন্ম বেড়ে না ওঠে, তবে প্রতিভা কোথা থেকে আসবে? মাঠভিত্তিক খেলাধুলার সংকট মানে আগামী দিনের ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার অভাব, আন্তর্জাতিক মঞ্চে পিছিয়ে পড়া। এখনই যদি উদ্যোগ না নেওয়া হয়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। স্কুলের পাঠ্যক্রমে শারীরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। “ফিট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট” যেন কেবল স্লোগান না থেকে বাস্তবে মাঠভিত্তিক কার্যক্রমে রূপ নেয়। শহর ও গ্রামে নতুন খেলার মাঠ, পার্ক ও ক্রীড়া অবকাঠামো তৈরি জরুরি। সপ্তাহান্তে ও ছুটির দিনে খেলার ইভেন্ট, মেয়েদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগ, এবং বিনামূল্যে ক্রীড়া ক্লাব চালু করা দরকার।
অভিভাবকরা শিশুদের স্ক্রিনটাইম সীমিত করে বাইরে নিয়ে আসুন। নিজেরাও খেলাধুলায় অংশ নিলে শিশুদের উৎসাহ বাড়বে। ভারতের তরুণ প্রজন্ম যদি মাঠের খেলাধুলা থেকে সরে আসে, তবে ভবিষ্যৎ হবে এক প্রযুক্তিনির্ভর কিন্তু শারীরিকভাবে দুর্বল ও সামাজিকভাবে অক্ষম প্রজন্ম। এখনই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমরা কি পর্দার আলোয় আটকে রাখা এক প্রজন্ম গড়ব, নাকি মাঠের সবুজ ঘাসে বেড়ে ওঠা এক সুস্থ, প্রাণবন্ত ও প্রতিযোগিতামূলক প্রজন্ম তৈরি করব।
