মানুষ মূলত সামাজিক প্রাণী। সমাজে পারস্পরিক সহযোগিতা, শ্রদ্ধা ও মানবিকতার ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে সভ্যতা। কিন্তু আজকের দ্রুতগামী ভোগবাদী পৃথিবীতে এই সামাজিক মূল্যবোধগুলো ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নতি যেমন আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, তেমনি মানুষের মধ্যে দূরত্বও বাড়িয়ে তুলেছে। আত্মকেন্দ্রিকতা, প্রতিযোগিতা ও অর্থলোভের ভিড়ে মানবিকতা যেন হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
এক সময় পরিবার ছিল নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের প্রধান বিদ্যালয়। সন্তানরা বড়দের সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা, সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ শেখত ঘর থেকেই। কিন্তু আজকের পারিবারিক কাঠামো বদলে গেছে। পারিবারিক বন্ধন শিথিল, একক পরিবারে বড় হওয়া শিশুদের মধ্যে সামাজিক সংবেদনশীলতা আগের মতো গড়ে উঠছে না। বাবা-মায়ের ব্যস্ততা, সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব এবং বাস্তব জীবনের যোগাযোগের অভাবে নতুন প্রজন্ম অনেক সময় মানবিক গুণাবলির চর্চা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
শিক্ষাব্যবস্থাতেও নৈতিক শিক্ষার চর্চা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিদ্যালয় এখন অনেক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র পরীক্ষা ও চাকরির প্রস্তুতির কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন সৎ, দায়িত্বশীল ও সহানুভূতিশীল মানুষ— কেবল ডিগ্রিধারী নয়। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আবারও মানবিক শিক্ষা ও মূল্যবোধভিত্তিক কার্যক্রমকে গুরুত্ব দিতে হবে।
মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখনকার তরুণরা সংবাদ বা তথ্যের চেয়ে বেশি সময় কাটায় ভার্চুয়াল দুনিয়ায়। সেখানে যে ধরনের বিষয়বস্তু তারা দেখে, তা তাদের চিন্তা ও মূল্যবোধে গভীর প্রভাব ফেলে। তাই মিডিয়ার দায়িত্ব— ইতিবাচক, মানবিক ও সামাজিক ঐক্যের বার্তা প্রচার করা।
তবে আশার কথা হলো, সমাজে এখনো অনেক মানুষ আছেন যারা নীরবে কাজ করছেন মানবতার সেবায়। যুব সমাজের অনেকেই পরিবেশ রক্ষা, শিক্ষা প্রসার বা দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমে সামাজিক মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ ঘটাচ্ছেন। এই ধরনের উদ্যোগই দেখায়— সব কিছু হারিয়ে যায়নি, শুধু প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা।
সামাজিক মূল্যবোধ কোনো বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি প্রতিদিনের জীবনের অংশ। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র— এই তিনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই সমাজে আবারও মানবিকতার আলোর প্রদীপ জ্বালানো সম্ভব। যদি আমরা প্রত্যেকে নিজের মধ্যে সততা, সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করতে পারি, তবে সমাজ আবারও ফিরে পাবে তার হারানো মূল্যবোধ। আজ থেকেই শুরু হোক সেই পরিবর্তনের যাত্রা— নিজের ভেতর থেকে, নিজের সমাজে।
